ভোলায় ইউপি নির্বাচন সহিংসতা ,ব্যালট পেপার ছিনতাই, ভাঙচুর, সংঘর্ষ , পুলিশ-মেম্বার প্রার্থীসহ আহত তিন শতাধিক

লালমোহন বিডিনিউজ ,ভোলা প্রতিনিধি : উৎসবের পাশাপাশি বিচ্ছিন্ন সহিংসতা, ভোট কেন্দ্র দখল ও ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে ভোলায় শেষ হয়েছে নবম ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ। ২২ মার্চ মঙ্গলবার সকাল থেকে জেলার ৩৬টি ইউনিয়নে শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণ শুরু হলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে শুরু হয় সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা। বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা। তজুমদ্দিন ও মনপুরা উপজেলা ছাড়া বাকী ৫ উপজেলার ৩২টি ইউনিয়নের ১শ’ কেন্দ্রেই মেম্বার প্রার্থী গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সংর্ঘষ, গুলিবর্ষণ, বোমা বিস্ফোরণ, ব্যালট বাক্স ছিন্তাই, হাতের কবজি কাটা, নারীদের ওপর নির্যাতন, ঘর-বাড়িতে হামলা লুট, এজেন্ট বেড় করে দেয়া, ওপেন সিলমারা, ১০টি কেন্দ্রে সাময়িক ভোট গ্রহণ বন্ধ ও ৩টি স্থায়ীভাবে ভোট গ্রহণ বন্ধ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ তিনজনসহ অন্তত তিন শতাধিক কর্মী-সমর্থক আহত হয়। এর মধ্যে গুরুতর আহত দুই শতাধিককে ভোলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে ৫ জনকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়া ১৩ চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোট বর্জন করেছে।
বিভিন্ন স্থান থেকে তথ্য অনুযায়ী, ভোলা সদর উপজেলার ১০ ইউনিয়নের প্রত্যেক ইউনিয়নের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সংঘাত হয়েছে। বাপ্তা ইউনিয়নের মুছাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মেম্বার প্রার্থী মনির ও ইলিয়াস গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ, কেন্দ্র দখল, গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ ৯ রাউন্ড সর্টগানের ফাকা গুলি ছোড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ইয়াদুর রহমান জানান, ওই কেন্দ্রে প্রায় ঘণ্টা খানেক ভোট গ্রহণ বন্ধ রাখা হয়। এছাড়া কলঘাট ৬ নম্বর ওয়ার্ড, চর সামাইয়া ইউনিয়নের বড় চরসামাইয়া দাখিল মাদ্রাসার ৪নং ভোট কেন্দ্রে দুই সদস্য (ভেনগাড়ী ও তালা মার্কা) প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে ৪০ জন আহত হয়। তাদের মধ্যে ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি বিল্লাল ও ছাত্রলীগ সভাপতিসহ ৫ জন গুরুত্বর আহত হন। ভেলুময়িা-৭ নম্বর ওয়ার্ড, বাপ্তার ৪ নম্বর ওয়ার্ড, পশ্চিম ইলিশা বাঘারহাট এলাকায়, উত্তর দিঘলদী ইউনিয়নে ৮ নম্বর ওয়ার্ড, ধনিয়া ইউনিয়নের ৫ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘাতে আহত হয়েছে অন্তত দেড় শতাধিক আহত হয়।
ওই ইউনিয়নের আওয়ামীলীগ দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী জেলা আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক ইয়ানুর রহমান বিপ্লব মোল্লা জানান, জামিরালতা কেন্দ্রে মেম্বার প্রার্থী হারুন মিঝি ও জসিম উদ্দিনের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছে। গুরুতর আহত প্রায় ১০-১২ জনকে ভোলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ সময় উভয় পক্ষই ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছে। ইউপি নির্বাচনে বিভিন্ন কেন্দ্রে মেম্বার প্রার্থী গ্রুপের সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে হাসাপাতালে গুরুতর ও আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তিকৃতরা হচ্ছে
ভোলা সদরের বাপ্তা ইউনিয়নের দক্ষিণ চরনোয়াবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভোট গ্রহণকে কেন্দ্র করে মোঃ হারুন মিয়াজী (ফুটবল) প্রতীকের সাথে মোঃ জসিম উদ্দিন (মোরগ) প্রতীকের মধ্যে সংর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়। সেখানে কিছুক্ষণের জন্য ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হলেও পরবর্তীতে পুনরায় আবার ভোট গ্রহন সম্পন্ন হয়। তাদের এই দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মোঃ নাছির (৫০), বিল্লাল (৩৫), জাহাঙ্গীর (২০), সোহাগ (২৫), নয়ন (৩৭), অনিক (২৫), আকবর (২৫), খলিল (৩৫) গুরুত্বর আহত হয়। তাদেরকে ভোলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পশ্চিম ইলিশার মুছাকান্দি এলাকার মোঃ ইলিয়াস (ফ্যান প্রতীক)’র হামলায় মোঃ মনির (টিউবওয়েল প্রতীক)’র সমর্থক মোঃ রিয়াজ (৩৫) এবং ৮নং ওয়র্ডের মোঃ জসিম উদ্দিন (তালা) প্রতীকের সাথে সাহেব আলী মিয়ার মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়। এর মধ্যে ওমর ফারুক (৪০) নামের এক কর্মীকে ভোলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ধনিয়া ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডে মোঃ আজাদ (বল প্রতীক) কর্তৃক বর্তমান মেম্বার জাকির হোসেন মিঠু নিজেসহ মাহামুদুল হোসনে (৪০), আব্বাস (২৫), কালু, মোস্তফা, আমির, দেলোয়ার।
মোঃ ফারুক, ইসরাফিল, শরিফ, আলাউদ্দিন, মনির, সালাউদ্দিন, কালাম, ইসমাইল, জসিম মেম্বার, আব্দুর রহমান, আকবর, মোঃ সালাম, সুজন, মোঃ চুন্নু, বিএনপি নেতা আলম মেম্বার, শাখাওয়াত, কলঘাটের মোঃ ইউনুছ, শাহাদাত হোসেন, ভেলুমিয়ার ইব্রাহিম, ইব্রাহিম খলিল।
চরসামাইয়া ইউনিয়নের যুবলীগ সভাপতি মোঃ বিল্লাল হোসেন, পশ্চিম ইলিশার মেহেরাফ, ইসলাল, আব্দুল্লাহ, বোরহানউদ্দিনের ৫ নং মানিকা এলাকার ফাতেমা, টবগী ৩ নং ওয়ার্ডের গলাকাটা মনির (এর গলা কেটে ফেলার চেস্টা করা হয়), হাত প্রায় বিচ্ছিন্ন হওয়া সুজন, সুজনের হাতের বাহু প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
লালমোহন উপজেলায় ২টি ইউনিয়নের নির্বাচনের মধ্যে ধলীগৌরনগর ইউনিয়নে ফের কব্জি কাটার ঘটনা ঘটেছে। দুই দিন আগে মেম্বার প্রার্থী জাকির হোসেনের হাতের কব্জি কেটে নিয়েছিল তার চাচাত ভাই মেম্বার প্রার্থী গিয়াস উদ্দিনের লোকজন। এর প্রতিশোধ নিতে ভোটের দিন গিয়াস উদ্দিনেসর বড় ভাই জামাল ভূইয়াকে কেন্দ্র থেকে ধরে নিয়ে পাশের এক বাড়িতে চোখ বেধে তার হাতের কব্জি কাটতে থাকা অবস্থায় র‌্যাব সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে হাসাপাতালে ভর্তি করে। এ সময় ৩ জনকে আটক করা হয়। ওই ঘটনার পর গিয়াস উদ্দিন ভোট বর্জন করার ঘোষণা দেন। এমন ঘোষণার পরপর জাকির হোসেনের লোকজন আশপাশের বাড়িতে বাড়িতে হামলা শুরু করে। এ সময় ঘরবাড়ি লুট করার পাশা-পাশি নারীদের ওপর নির্যাতন চালায় বলে গিয়াস ভুইয়া অভিযোগ করেন। আগের রাতেও জাকিরের লোকজন চান মিয়া হাজি বাড়িতে হামলা করে ৮টি ঘর ভাঙচুর ও লুট করেছে। ওই এলাকায় এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। এছাড়া লালমোহন ইউনিয়নের ৫ ও ২ নম্বর কেন্দ্রে সংঘর্ষে আহত হয় ১৫ জন। এ ছাড়াও জামাল ভুইয়া, ইকবাল, আলী আহমেদ, ইলিয়াস ও মোঃ জসিমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
দৌলতখান উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে চরখলিফা ইউনিয়নের দিদারুল্লাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম চর খলিফা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর পূর্ব চরখলিফা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩ নম্বর ওয়ার্ড কেন্দ্র, চরপাতা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড কেন্দ্র, সুকদেব স্কুল মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে দফায় দফায় সংর্ঘষে আহত হয়েছে কমপক্ষে ৩০ জন। ৩টি ভোট কেন্দ্র স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ২টি সাময়িক বন্ধ করে এক ঘন্টা পর ফের ভোট গ্রহণ শুরু হয়।
চর খলিফার ৩ নম্বর কলাকোপা কেন্দ্রে মেম্বার প্রার্থী নান্নু মিজি, আবুল কালামের এজেন্টদের বেড় করে দিয়ে প্রকাশ্যে সিল মারতে থাকে মিলন খানের লোকজন। এ সময় মিলন খানের বাহিনীরা ৭টি দোকান ও বাড়িতে ভাঙচুর ও লুট করে। গিয়াস উদ্দিন (বল প্রতীক) কর্তৃক দুলাল (মোরগ প্রতীক)’র সমর্থক আলমগীর (৫০) কে বেধরক মারধর করে।
বোরহানউদ্দিন উপজেলার কুতুবা, সাচড়া, কাচিয়া ও টবগী ইউনিয়নে সংর্ঘষে অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আবুল কালাম। এছাড়া কুপিয়ে মমিনের গলা ও সুজনের হাত কাটার চেষ্টা করা হয়। বোরহানউদ্দিন উপজেলার কুতুবা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ সময় ওই কেন্দ্রের সহকারি প্রিজাইডিং অফিসারসহ অন্তত ৫ জন আহত হন।
২২ মার্চ মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে একই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ কুতুবা কেন্দ্রে দুই মেম্বার প্রার্থী বাচ্চু নক্তি ও হুমায়ুন গোলদারের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে মেম্বার প্রার্থী বাচ্চু নক্তির ভাবী মায়ানুর বেগমসহ অন্তত ৫ জন আহত হয়েছে। বেলা সোয়া ১১টার দিকে বোরহানউদ্দিন উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের রেডরোজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মেম্বার প্রার্থী আব্দুল আজিজের (ফুটবল প্রতীক) ভাই দিন ইসলাম রুবেল অভিযোগ করে জানান, তার ভাই আব্দুল আজিজের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী মেম্বার প্রার্থী রাজ্জাকের (আপেল প্রতীক) কর্মী-সমর্থকরা।
চরফ্যাশন উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে চরকলমি, এওয়াজপুর, নজরুলনগর ইউনিয়নে মেম্বর প্রার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। বাবুরহাট কেন্দ্রে চেয়ারম্যান প্রার্থীর ভাই বাবুল হাওলাদারের নেতৃত্বে কেন্দ্র দখল করে সিল মারার অভিযোগে ওই কেন্দ্রে হামলা হয়। এ সময় প্রায় এক ঘণ্টা ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে।
চরফ্যাশন হাসপাতালের উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম জানান, ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৫০ জন। বোরহানউদ্দিন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৫ জন। দৌলতখান হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৬ জন। ওই উপজেলার আহত ১৫ জন ভোলা হাসাপাতালে চিকিৎসা নেয়।
জেলার ৩৬টি ইউনিয়নের ২ হাজারেরও বেশি প্রার্থী চেয়ারম্যান ও সাধারণ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। সর্বমোট ৪শ’ ১টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ৩শ’ ৬৬টি ভোটকেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ভোলা সদর মডেল থানার ওসি মীর খায়রুল কবির জানান, বিভিন্ন কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের চেষ্টাকালে এবং কেন্দ্রে ও কেন্দ্রের বাইরে বিশৃঙ্খলার কারণে সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অনেক কেন্দ্রে পুলিশ গুলিবর্ষণ করেছে। তবে কত রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছে তা এই মুহুর্তে তিনি জানাতে পারেননি।
এ ব্যাপারে ভোলা জেলা পুলিশ সুপার মোহাঃ মনিরুজ্জাম জানান, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণের লক্ষে নির্বাচনী মাঠে ৮ হাজার আনসার, ২ হাজার ৪শ’ ৫০ জন পুলিশ, ৭ প্লাটুন র‌্যাব, ৭ প্লাটুন বিজিবি, ৬ প্লাটুন কোস্টগার্ডের মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স এবং ২৮ জন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ও জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছে। এর পরও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হয়।