বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ ২০১৮
প্রথম পাতা » জেলার খবর | দৌলতখান | শিক্ষা | শিরোনাম | সর্বশেষ » দৌলতখান মদনপুরের বিদ্যালয় চলছে ভাড়াটিয়া শিক্ষক দিয়ে।। লালমোহন বিডিনিউজ
দৌলতখান মদনপুরের বিদ্যালয় চলছে ভাড়াটিয়া শিক্ষক দিয়ে।। লালমোহন বিডিনিউজ
লালমোহন বিডিনিউজ, দৌলতখান প্রতিনিধি : ভোলার দৌলতখান উপজেলার মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন মদনপুরের তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় চলছে ভাড়াটিয়া শিক্ষক দিয়ে। ৩টি বিদ্যালয়ের নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ না এসে ৩/৪ হাজার টাকায় পঞ্চম ও এসএসসি পাশ লোক দিয়ে চালাচ্ছেন ক্লাস। শিক্ষকগণের অবহেলায় ৩টি বিদ্যালয় প্রায় ৪ শতাধিক শিক্ষার্থী শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিদ্যালয়গুলো হচ্ছে ৬৪ নং চর টবগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩৯নং চর পদ্মা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৩৮ নং চর পদ্মা মকবুল আহমেদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
সূত্রে জানা যায়, মদনপুর ইউনিয়নটি উপজেলার মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সেখানকার তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ নিয়মিত বিদ্যালয়ে নিয়মিত না এসে ভাড়াটিয়া শিক্ষক দিয়ে চালাচ্ছেন পাঠ কার্যক্রম। ফলে অনেক ছাত্র/ছাত্রী বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিবাবকরাও রয়েছে দুঃশ্চিন্তায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রায় ৫-৬ জন শিক্ষার্থীর অভিবাবক জানান, এখানে স্কুলের শিক্ষকরা তাদের মন মত আসে-যায়। সপ্তাহে এক দুই দিন আসলেও কোনো ক্লাস না করে দেড়-দুই ঘন্টা বিদ্যালয়ে থেকে বাড়ি চলে যায়। এই ইউনিয়নটিতে শিক্ষা অফিসের কোনো নজরদারি না থাকার কারণে শিক্ষকরা এ অনিয়ম করছে। মাঝে মধ্যে শিক্ষা অফিসার আসলে শিক্ষকদেরকে আগে থেকেই অফিসের লোকজন খবর দিয়ে দেয়। সে দিন শিক্ষকগণ ভোরে এসে বিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করে।
এছাড়াও ইউনিয়নটিতে এক মাত্র যোগাযোগ মাধ্যম হলো ট্রলার। তাও নির্দিষ্ট সময় ছাড়া যাওয়ার সুযোগ নেই। এ সুযোগে সেখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা কোনো প্রকার নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের মনগড়া ভাবে স্কুল চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন অনেকে।
সূত্রে আরো জানা যায়, ৬৪ নং চর টবগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ২০১৫ সালে সরকারের একটি বিশেষ বরাদ্দ থেকে নির্মাণ করা হয়। বিদ্যালয়টি স্থাপন করার পর থেকে কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি সেখানে। প্রথম থেকেই এই বিদ্যালয়টি চলছে ডেপুটেশন শিক্ষক দিয়ে। বর্তমানে বিদ্যালয়টির সব ক্লাশ মিলিয়ে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষক রয়েছে মাত্র দুই জন। তাও আবার ডেপুটেশনে। একজন ৩৯ নং চর পদ্মা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মো. মুসা কালিমুল্লাহ। অপরজন ৩৮নং চর পদ্মা মকবুল আহমেদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হাসনা বেগম।
মুসা কালিমুল্লাহ চলতি বছরের জানুয়ারী মাস থেকে দেড় বছরের জন্য পিটিআই ট্রেনিংয়ে রয়েছে। আর হাসনা বেগম সকাল সাড়ে ১০টায় এসে ১২টার আগেই বিদ্যালয় ছুটি দিয়ে চলে যায়। এই বিদ্যালয়ে ভাড়াটিয়া শিক্ষক হিসেবে রয়েছে পঞ্চম শ্রেণী পাশ জোসনা বেগম। সে গত ৩ বছর ধরে এখানের ডেপুটেশন শিক্ষক মুসা কালিমুল্লাহর পরিবর্তে মাসিক ৮শ’ টাকার বিনিময়ে ক্লাস নিচ্ছেন। তাও চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে মুসা কালিমুল্লাহ পিটিআই ট্রেনিংয়ে যাওয়ার কারণে সে টাকাও দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ভাড়াটিয়া শিক্ষক জোসনা বেগম।
বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর এক ছাত্রীর বাবা আ. রহিম জানান, স্কুলের বর্তমান শিক্ষক হাসনা বেগম সকাল সাড়ে ১০টায় এসে আবার ১২টার আগে চলে যায়। স্কুলের শিক্ষার্থীরা ৩-৪ বছর ক্লাস করেও নিজের নাম লিখতে পারে না।
বিদ্যালয়ের ডেপুটেশন শিক্ষক হাসনা বেগমের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, তার পক্ষে এর চেয়ে বেশী ক্লাস নেয়া সম্ভব না। তার বাসায় একজন প্রতিবন্ধি শিশুসহ ৩ জন সন্তান রয়েছে। তাদের খাওয়া দাওয়া করিয়ে আসতে দেরী হয়। আর চরে অন্য স্কুলের শিক্ষকরা যদি ৪টা পর্যন্ত ক্লাস নেন তাহলে সেও নিতে রাজি আছেন।
ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডে অবস্থিত সদ্য জাতীয়করণকৃত ৩৯ নং চর পদ্মা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এটি দ্বিতীয় ধাপে জাতীয়করণ করা হয়। সে থেকে এই বিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষক নিয়মিত বেতন তুলছেন। তারা হলেন আঃ সাত্তার ওরফে শাহিন, রাবেয়া, মুসা কালিমুল্লাহ ও রাবেয়া আক্তার। এই বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মুসা কালিমুল্লাহ জাতীয় করণের আগ থেকেই চর টবগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডেপুটেশনে রয়েছে। বাকি তিন জনের মধ্যে আঃ সাত্তার ও রাবেয়া চলতি বছরের জানুয়ারী মাস থেকে দেড় বছরের জন্য পিটিআই ট্রেনিংয়ে রয়েছে। বাকি রাবেয়া আক্তার গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে বিদ্যালয়ে না এসে তার ২০১৭ সালে এসএসসি পাশ ভাগ্নি তহমিনা আক্তার তিশাকে দিয়ে ক্লাস করাচ্ছেন। স্কুলটিতে বর্তমানে মোট ১শ’ ১৪ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। যা একজন ভাড়াটিয়া শিক্ষকের দ্বারা ক্লাশ নেয়া সম্ভব নয়। ভাড়াটিয়া শিক্ষক তহমিনা আক্তার তিশা সকাল সাড়ে ৯টায় এসে ১২টায় চলে যায়। স্কুলের ভাড়াটিয়া শিক্ষক তহমিনা আক্তার তিশা বলেন, তার খালা অসুস্থ্য থাকায় তার পরিবর্তে সে ক্লাস নিচ্ছেন।
ইউনিয়নে ৫নং ওয়ার্ডে অবস্থিত ৩৮নং চর পদ্মা মকবুল আহমেদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও দ্বিতীয় ধাপে জাতীয় করণ করা হয়েছে। প্রথম থেকেই বিদ্যালয়টি থেকে ৪ জন শিক্ষক বেতন তুলছেন। তারা হলেন মোঃ শিহাব উদ্দিন, শাহিনা আক্তার, রুনা বেগম ও হাসনা বেগম। এদের মধ্যে মোঃ শিহাব উদ্দিন চলতি বছরের জানুয়ারী মাস থেকে পিটিআই ট্রেনিংয়ে রয়েছে। হাসনা বেগম ৬৪ নং চর টবগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডেপুটেশনে ক্লাশ নিচ্ছেন। বাকী দুই শিক্ষকের মধ্যে শাহিনা আক্তার কোন প্রকার অফিসের অনুমতি ছাড়াই তার পরিবর্তে চলতি মাসের ৫ তারিখ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত এসএসসি পাশ মোঃ মুইন নামের এক ছেলেকে দিয়ে ক্লাস করাচ্ছেন এবং রুনা বেগম তার পরিবর্তে তার স্বামী মহিউদ্দিনকে দিয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাস থেকে ক্লাস করাচ্ছেন। তার স্বামীও নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেন না বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে স্কুলের শিক্ষক শাহিনা আক্তার বলেন, তার অসুস্থ্যতার জন্য সে মুইনকে দিয়ে অল্প কয়দিনে জন্য ক্লাস করিয়েছেন। অপর শিক্ষক রুনা বেগম জানান, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পিটিআই ট্রেনিংয়ে থাকায় বিদ্যালয়ে বিভিন্ন ট্রেনিং ও মিটিংয়ে যেতে হয়। তার জন্য তার স্বামীকে দিয়ে সে ক্লাস করাচ্ছেন।
ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিন নান্নু বলেন, আমিও শিক্ষকদের ভাড়াটিয়া শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ শুনেছি। বদলি শিক্ষকরাও ক্লাস করছেন না। এ জন্য শিক্ষকদের নিয়মিত ক্লাস করার জন্য জরুরী সভা ডেকে তাগিদ দিয়েছেন।
দৌলতখান উপজেলা শিক্ষা অফিসের সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, কোনো শিক্ষক তাঁর নিকট থেকে ছুটি নেয়নি। আর অফিস কাউকে ট্রেনিংএ পাঠাইনি। তবে ওই ইউনিয়নের বেশিরভাগ শিক্ষককে আগের শিক্ষা কর্মকর্তা পিটিআইতে ট্রেনিং-এ পাঠিয়েছেন।
দৌলতখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ কামাল উদ্দিন বলেন, তিনি একবার চরে বিদ্যালয় ভিজিটে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন। কিন্তু দৌলতখানে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা না থাকায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছেন না।
ভোলা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নিখিল চন্দ্র হালদার বলেন, বদলি শিক্ষক দিয়ে ক্লাশ করার কোনো বিধান নেই। এটা সম্পূর্ণ বে-আইনী। যাকে সরকার নিয়োগ দিয়েছে তাঁরই ক্লাশ করতে হবে। অন্যদিকে সব শিক্ষক পিটিআইতে পাঠিয়ে কীভাবে বিদ্যালয় চলে, এটা খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।