
বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » চরফ্যাশন | শিরোনাম | সর্বশেষ » ভোলার চরনিজামের বাসিন্দারা সরকারী বনদস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ট, রক্ষা করবে কে?
ভোলার চরনিজামের বাসিন্দারা সরকারী বনদস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ট, রক্ষা করবে কে?
লালমোহন বিডিনিউজ ,চরফ্যাসন প্রতিনিধি : ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলার উত্তর সাকুচিয়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড চরনিজাম।এ মৌজাটি মনপুরা উপজেলার অন্তর্গত হলেও মনপুরার সাকুচিয়া থেকে ট্রলারযোগে মনপুরা থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দুরের এ চরটিতে যেতে প্রায় ৪ ঘন্টা সময় লাগে। চরনিজামের আরেক নাম কালকিনি, কালকিনি থেকে প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার একটি ট্রলার চরফ্যাশনে যাতায়াত করে। ট্রলারটি চরফ্যাশনের চরমাদ্রাজের নতুন সুইজ ঘাট থেকে প্রতি রবিবার ও বুধবার কালকিনি যায়। জেলা প্রশাসক, ভোলা মহোদয়ের কার্যালয় থেকে আন্তঃ উপজেলা ফেরীঘাট ইজারা নিয়ে এ লাইনটি ছিডু মাঝি নামের এক ইজারাদার চালায়। চরফ্যাশন উপজেলা থেকে এ চরে যাতায়াত করতে মাত্র ২ ঘন্টা সময় লাগে। যার ফলে, চরনিজামের লোকজন মনপুরায় না গিয়ে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার চরফ্যাশন বাজারে চলে আসেন তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করার জন্য।
চরনিজাম মৌজায় বনবিভাগের গেজেটভুক্ত জমির বাইরে আবাদী জমির পরিমান প্রায় ২৫ হাজার একর। গত ২০০৪ সালের ১৭ জানুয়ারী তারিখ বন বিভাগের এক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে চর নিজাম মৌজায় ১০৪৫.৬৩ হেক্টর জমি বনায়নের জন্য গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বনবিভাগের গেজেটভুক্ত জমির সাথে আবাদি জমি যা স্থানীয় বাসিন্দারা দীর্ঘ ৫০/৬০ বছর পূর্ব থেকে বাড়ীঘর সৃজন করে চাষাবাদ করছেন, তার সাথে কোন সম্পর্ক নাই। অর্থাৎ স্থানীয় বাসিন্দারা বন বিভাগের গেজেটভূক্ত সংরক্ষিত বনভূমির মধ্যে প্রবেশ করছেন না। বনবিভাগ তার গেজেট ভূক্ত এরিয়ার মধ্যে না থেকে বনাঞ্চলকে দিনকে দিন লোকালয়ের দিকে সম্প্রসারিত করে চলছে।
চরনিজাম এলাকায় প্রায় ৩০০০ লোকের বসবাস। বর্তমান ভোটার সংখ্যা ৯৯৮ জন, ০১টি প্রাইমারি স্কুল, ১ টি বাজার, ১টি পুলিশ ক্যাম্প, রয়েল সুইডিস এ্যাম্বেসী কর্তৃক নির্মিত একটি গুচ্ছগ্রাম আছে। অধিবাসিদের মধ্যে এ পর্যন্ত ১২৭৩ একর সম্পত্তি বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়েছে। ১৯৫৮-৫৯ সালে ৭২টি, ১৯৫৯-৬০ সালে ১৪টি, ১৯৬৬-৬৭ সালে ৩৩৪টি মোট ৪২১ টি পরিবারকে ১২৭৩ একর জমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়েছে। ১৯৮৫-৮৬ সালে মহামান্য রাস্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতাবলে ৭০টি পরিবারকে ৩.০০ একর করে মোট ২১০.০০ একর সম্পত্তি বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়েছে। এ মৌজার সবর্মোট ১৪৮৩ একর জমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়েছে।
বনবিভাগের গেজেটভুক্ত জমির বাইরে প্রায় ২৫০০০ হাজার একর জমি থাকা সত্ত্বেও বন্দোবস্ত গ্রহীতার বন্দোবস্তকৃত ১৪৮৩ একর জমিসহ পুরো চরনিজাম মৌজায় বনবিভাগের সরকারী বনদস্যুদের রাজত্ব চলছে। বনবিভাগের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে স্থানীয় বাসিন্দাগণ ও বন্দোবস্ত গ্রহীতাগণ একাধিকবার সদাসয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপের জন্য আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিগত কয়েকজন উপজেলা নির্বাহি অফিসার স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতি বনবিভাগের সরকারী বনদস্যুদের অত্যাচার, নির্যাতনের করুণ চিত্র তুলে ধরে জেলা প্রশাসক এবং বিভাগীয় কমিশনার মহোদয় বরাবর প্রতিবেদন পেশ করার পরও স্থানীয়দের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি।
১৯৫৮-৫৯,১৯৫৯-৬০, ১৯৬৭-৬৮,১৯৮৫-৮৬, ২০০৪-২০০৫ এর বন্দোবস্ত ্গ্রহীতারা রিজার্ভ ফরেস্টের বাইরে বাড়ীঘর স্থাপন করে বসবাস করছেন। এ অঞ্চলের মানুষ বনবিভাগের কোন সম্পত্তির ভেতরে কখনই অনুপ্রবেশ করে না। বরং বনবিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীগণ জোড় পূর্বক বণ্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত স্থানীয় গরীব বন্দোবস্ত গ্রহীতা এবং সরকারী খাস জমিতে বসবাসরত ভূমিহীন প্রজাদের উপর অকথ্য অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা এবং জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলাপ করে জানা যায় যে, সরকারী খাস জমি যা ভূমিহীনরা দখলে আছে, সে জমিসহ বন্দোবস্তকৃত জমিও বনবিভাগ দাবী করে স্থানীয়দের নির্যাতন চালায়। বন্দোবস্তীয় রেজিষ্ট্রিকৃত কবুলিয়তের কোন দাম বনবিভাগের কাছে না থাকলেও বাসিন্দাদের একর প্রতি ৫০০/- টাকা নিয়ে জমি চাষাবাদ করতে দিচ্ছে বন বিভাগের লোকেরা। বাৎসরিক ধার্যকৃত টাকা না দিলে পরের বছর উৎখাত।
এছাড়া স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী দালাল চক্র তৈরী হয়েছে বনবিভাগকে ঘিরে। ঐ সকল দালাল চক্র এক সময়ের একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী স্থানীয় নেতা। দল ক্ষমতায় না থাকলেও তারা সব সময় ক্ষমতা রাখেন। এ সকল দালালরা প্রত্যেকেই বনবিভাগের সাথে আঁতাত করে ৫/৭ একরের মৎস্য ঘের তৈরী করে নিজেদের আখের মজবুত করছেন। ভিটি শ্রেণীর সরকারী খাস জমিতে ভূমিহীন প্রজারা মোটা অংকের টাকা দালালদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এক ভিটির জন্য প্রায় ১৬ শতক জমির দখল হস্তান্তর করা হয় ২৫/৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে। দালালদের মাধ্যমে প্রদানকৃত ভিটির মধ্যে বনবিভাগের মূল্যবান কোন বৃক্ষ থাকলেও দালাল চক্র এবং বনবিভাগের অনুগ্রহে নির্ভয়ে কেটে ফেলা হচ্ছে। এভাবে ভূমিহীন প্রজাদের ভিটির জন্য সরকারী খাস জমিকে বন বিভাগের জমি দাবী করে কোটি টাকার বাণিজ্য চলছে কালকিনি তথা চরনিজামে। আদায়কৃত টাকা দালালচক্র এবং বনের লোকের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে।
স্থানীয়রা সরকারী খাস জমিতে গরু মহিষ চড়ালেও তাদের প্রতি গরু এবং মহিষেরর জন্য বছরে ৪০০/- টাকা করে ধার্য করে আদায় করা হচ্ছে। এসব ধার্যকৃত টাকা কেউ না দিলে বনের গাছ কাটা মামলা দিয়ে হয়রাণী করা হচ্ছে (বনের গাছ কাটা মামলায় নুন্যতম সাজা ৬ মাস এবং কোন জড়িমানা না থাকায় প্রায় প্রত্যক আসামীকে কমপক্ষে ৬ মাস কারা ভোগ করতে হয়)। অধিকন্তু দাবীকৃত টাকা আদায় করতে না পেরে স্থানীয়দের গবাদি পশুকে তারা খোয়ারে দিচ্ছে। যিনি খোয়ারের ইজারাদার তিনি বনবিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মীকে একটি গরু,মহিষের জন্য ৫০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। স্থানীয়দের নিকট থেকে বনবিভাগের লোকজন প্রতিদিন গড়ে ২৫/৩০ হাজার টাকা আদায় করে থাকে।
বিগত ২০১১ সালের ১৮ জুলাই তারিখ স্থানীয় বন্দোবস্ত গ্রহীতাগণ ভূমি অফিসের মাধ্যমে তাদের বন্দোবস্তীয় জমির পিলার স্থাপন করলে তৎকালীন বন সংরক্ষক, কোষ্টাল সার্কেল, বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার, বরিশাল মহোদয়ের নিকট ১০০ জন অবৈধ দখলদার বনবিভাগের জমি জোড় পূর্বক দখল করেছে মর্মে পত্র প্রেরণ করে। একটা জেলার সকল খাস জমির মালিক পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক। বনবিভাগ জনগণের জান-মালকে ঝড় ঝঞ্জা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন থেকে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে রক্ষার নামে মাত্র ২০ বছরের জন্য সরকারের অনুমতি নিয়ে সরকারী খাস জমিতে বনায়নের জন্য গেজেট প্রকাশ করে।
২০ বছর পর বনবিভাগের অনুকূলে প্রত্যাপর্ণকৃত ভূমি আপনাআপনি জেলা প্রশাসকের অনুকূলে বর্তানোর যে আইন রয়েছে, তা বন বিভাগ মানতে চায় না। একবার একটি অঞ্চলে, বনায়নের অনুমতি পেলে ৫০/৬০ বছর অতিক্রান্ত হলেও বনবিভাগ মেয়াদোত্তীর্ণ ভূমি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের অনুকূলে প্রত্যাপর্ণ করছে না। ভোলা জেলার বনবিভাগের প্রতিটি রেঞ্জের আওতায় বন্দোবস্ত যোগ্য মেয়াদোত্তীর্ণ জমির মোট পরিমান এক লক্ষ একরেরর কম নয়। বনবিভাগকে যে পরিমান জমি গেজেট করতে দেয়া হয় তারা কখনই সে পরিমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তারা বন্য হাতির মতো লোকালয় ধ্বংস করে দিতে চায়। বনবিভাগকে যে আইনের আওতায় ২০ বছর মেয়াদের জন্য বনায়নের অনুমতি প্রদান করা হয়, সে আইনে বনবিভাগকে জমির মালিকানা প্রদান করা হয় না।
কিন্তু ১৯৫০ সনের প্রজাসত্ব আইন, বর্তমান খাস জমি বন্দোবসস্ত নীতিমালা অনুযায়ী একজন ভূমিহীন প্রজাকে সরকার জেলা প্রশাসক মহোদয়ের মাধ্যমে ৯৯ বছরের জন্য একটি পরিবারকে ১.৫০ একর জমি বন্দোবস্ত প্রদান করে। যাতে বন্দোবস্ত প্রদানকৃত জমিতে বন্দোবস্ত গ্রহীতা ভূমিহীন প্রজার ৯৯ বছরের জন্য মালিকানা সৃষ্টি হয়। কিন্তু বনবিভাগ সে মালিকানা না মেনে ভূমিহীন প্রজার জমি গ্রাস করে অত্যাচার, নির্যাতন চালায়।
চরনিজামের মতো দুর্গম এলাকার অধিবাসিদের খবর কে রাখে, যেখানে সরকারী গেজেটের বাইরে এখনও প্রায় ২৪ হাজার একর জমি খাস, যা ভূমিহীন কৃষকের ন্যায্য পাওনা, যার প্রকৃত মালিক জেলা প্রশাসক তথা উপজেলা ভূমি অফিস সেখানে জেলা প্রশাসন কিংবা উপজেলা ভূমি প্রশাসনের কোন তদারকি না থাকলেও বন বিভাগ কোটি টাকার বাণিজ্য করছে সরকারী খাস জমি নিয়ে। বন বিভাগের এ জাতীয় পরের ধানে পোদ্দারী বন্ধ করার জন্য উপজেলা ভূমি প্রশাসন থেকে কঠোর ও কঠিণ পদক্ষেপ গ্রহণ করারর দাবী এলাকার জনগণের। স্থানীয় জনসাধারণ আদালতের মাধ্যমে বন বিভাগের লোকালয় ধ্বংসের অগ্রযাত্রা কঠোর হস্তে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর।
গত কিছুদিন আগে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে অতি জোয়ারের ফলে স্থানীয়দের কয়েক হাজার গরু মহিষ প্রল জোয়ারে নিরুদ্দেশ হয়, নিঃস্ব হয়ে যায় এলাকার গরীব দুঃখী মানুষগুলো। মনপুরা থেকে দূরত্বের কারণে এলাকার জনপ্রতিনিধগণ নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেন না। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে স্থানীয় দালাল চক্র ও বনবিভাগের লোকেরা। জনপ্রতিনিধিত্ববিহীন এ চরে একটি রাস্তার জন্য ২৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হলেও প্রয়োজনীয় মনিটরিং না থাকায় সেখানে নামমাত্র কাজ হয়েছে। বর্ষাকালে এ এলাকার লোকের জনদূর্ভোগের কোন শেষ খাকে না। রাস্তায় এক বুক কাঁদার মধ্যে দিয়ে স্কুলগামী ছেলেমেয়ে এবং পথচারীগণ চলাফেরা করে। শীতকালে চরনিজাম হয়ে উঠে প্রকৃতির এক রূপের রাণী। হরেক রকম পাখির সমাবেশ, রাস্তাঘাটে চলাচল ও আনন্দে ভ্রমণের জন্য উপযোগী হয়ে উঠে চরনিজাম।
মনপুরা উপজেলার ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহি অফিসার মনোয়ার হোসেন মহোদয় প্রতিকুল আবহাওয়া মোকাবেলা করে সম্প্রতি ২ বার মনপুরা গিয়ে তার অতিরিক্ত দায়িত্বের অনেক কাজ করায় চরনিজামের বাসিন্দাগণ আশার আলো দেখতে পেয়েছেন। তারা বিশ্বাস করেন জনাব মনোয়ার হোসেন মহোদয় খুব শীঘ্রই মনপুরা উপজেলার ভূতপূর্ব উপজেলা নির্বাহি অফিসারদের ন্যায় চরনিজামে যাবেন এবং এলাকাবাসীর দুঃখ দুর্দশার চিত্র স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে সরকারী সম্পদ ও স্বার্থ রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করবেন।
চরনিজামের জনগণ উত্তর সাকুচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, জনাব জাকির হোসেন এবং উপজেলা চেয়ারম্যান, জনাব সেলিনা আক্তার চৌধূরী এবং চরফ্যাশন-মনপুরার সংসদ সদস্য ও পরিবেশ বন মন্ত্রী আলজাজ্ব আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব মহোদয়ের সুদৃষ্টি কামনা করছেন।