শুক্রবার, ২৫ মার্চ ২০১৬
প্রথম পাতা » রাজনীতি | শিরোনাম | সর্বশেষ » ২৬শে মার্চের জিজ্ঞাসাঃ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর নাম নেই কেন ?
২৬শে মার্চের জিজ্ঞাসাঃ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর নাম নেই কেন ?
লালমোহন বিডিনিউজ ,সিরাজী এম আর মোস্তাক :বাংলাদেশে প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা কোটা অনুযায়ী প্রায় দুই লাখ যোদ্ধা এবং একচল্লিশ বীরাঙ্গনার যে তালিকা রয়েছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর নাম নেই। অর্থাৎ যে মহান নেতা এদেশের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবনকাল ব্যয় করেছেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন। তাহলে কি তিনি রাজাকার? “রাজাকার এ অভিধাটি ১৯৪৮ খ্রীষ্টাব্দে হায়দারাবাদে ভারতীয়দের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা নিজামের স্বেচ্ছাসেবকরা ব্যবহার করেছিল।” (ফজলুল কাদের কাদরী, বাংলাদেশ জেনোসাইড এন্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস, পৃষ্ঠা-১৩২, বাংলা অনুবাদ-দাউদ হোসেন)।
মুক্তিযুদ্ধে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অসামান্য। তাই ৭ই মার্চ থেকে ২৬শে মার্চ এ ২০ দিনে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত নাম- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কৈশোর থেকে তিনি ছিলেন সংগ্রামী চেতনাদ্দীপ্ত দুর্দান্ত সাহসী বীর। স্বাধীনতা ও মানবকল্যাণের জন্য তিনি অসংখ্যবার কারাবরণ করেছেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, বাঙ্গালির শোষণমুক্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি ছিলেন সংগ্রামী বীর। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তিনি ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুল বিজয় লাভ করেন। ্তারপরও তিনি সমঝোতার মাধ্যমে সরকার গঠনের চেষ্টা করেন। তিনিই প্রথম স্বাধীনতার ডাক দেন। “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” ৭ই মার্চে এ ঘোষণাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার মুলমন্ত্র। তিনি সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকে যার কাছে যা আছে, তাই নিয়ে লড়াই করার আহবান করেন। এ দুর্বার আহবানের জন্য পাকি শত্রুরা যুদ্ধের পুরোসময় তাকে কারারুদ্ধ রাখে। দেশবাসী তার এ আহবানে সাড়া দিয়ে সর্বাত্মক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং লাখো প্রাণ বিসর্জনের বিনিময়ে বিজয় ছিনে আনেন। তারা বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে দেশের ক্ষমতায় বসান। তাকে ‘বাঙ্গালি জাতির জনক’ খেতাব দেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে সমগ্র জাতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। যুদ্ধনীতি অনুযায়ী তিনি ৬৭৬ জন যোদ্ধাকে খেতাব দিয়ে অবশিষ্ট সকল জনতা, শহীদ, বন্দী ও আত্মত্যাগী নির্বিশেষে ‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকেই ‘সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা’ ঘোষণা করেন। একজন আত্মত্যাগী ও বন্দী যোদ্ধা হিসেবে নিজেও একজন ‘সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয় দেন। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সমর্থন ও খুনী পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিচারের উদ্দেশ্যে দালাল আইনে বিচারও শুরু করেন। কিন্তু সিমলা চুক্তির ফলে বিশেষ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ায়, বঙ্গবন্ধু নিজেই উক্ত বিচার বাতিল করেন এবং অভিযুক্ত দালালদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেন। এ দৃষ্টিতে, ১৯৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি যেমন মুক্তিযোদ্ধা, তেমনি রাজাকারও বটে। কেউ পাকিস্তানি রাজাকার, কেউ ভারতীয় রাজাকার। যারা পাকিস্তানের সহায়তা পেয়েছে, তারা পাকিস্তানি রাজাকার। আর যারা ভারতের সহায়তা পেয়েছে, তারা ভারতীয রাজাকার। যুদ্ধকালে দেশে অবস্থানকারী সকল জনতাই পাকিস্তানি রাজাকার। আর ভারতে অবস্থানকারী সকল নেতৃবৃন্দ, তথায় প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী এবং শরণার্থীগণ ভারতীয় রাজাকার।
মুক্তিযুদ্ধে এ রাজাকারি চেতনার জন্মদাতা বঙ্গবন্ধু নিজেই। ২৪ মার্চ, ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু ও পাকিস্তান সামরিক সরকারের সমঝোতা বৈঠক ব্যর্থ হলে যুদ্ধের আবহ শুরু হয়। তখন বঙ্গবন্ধু সময়োচিত সিদ্ধান্ত নেন। তার সহকর্মীদের আত্মগোপনে বা ভারতে যাবার নির্দেশ দেন। তাজউদ্দিন আহমদসহ প্রায় সকল নেতৃবৃন্দ একইভাবে বঙ্গবন্ধুকেও আত্মগোপনের পরামর্শ দেন। তারা বঙ্গবন্ধুকে হাত ধরে অনুরোধ করেন এবং হাউ-মাউ করে কান্না-কাটিও করেন। অনেকে বারবার ফোন করেও তাকে অনুরোধ করেন। সকল অনুরোধ ও কান্না-কাটি উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট জবাব দেন, ‘তোমরা পালাও কিন্তু আমি নয়। আমি পালালে, পাকবাহিনী শুধু আমাকে বা শেখ মুজিবকে খোঁজার নামে বাংলার সাধারণ মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করবে। তাই বাংলার মানুষের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করছি।’ এ মহান চেতনা নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর একান্ত সহকর্মী ড. কামাল হোসেন পাকবাহিনীর জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকেন। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তাঁরা অবরূদ্ধ হন।
করাচীতে পৌছার পর একটি ছবিতে বঙ্গবন্ধুকে পাকসেনা বেষ্টনিতে দেখা যায়।
এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারি চেতনার জন্ম হয়। যুদ্ধকালে পাকবাহিনী কোনো এলাকায় আক্রমণ করলে, বঙ্গবন্ধুপ্রেমী গেরিলা যোদ্ধাগণ উক্ত রাজাকারি চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে সামনে এগিয়ে আসেন। তারা পাকবাহিনীকে আশ্বস্ত করেন, তদীয় এলাকায় পাকিস্তান বিরোধী কেউ নেই। এভাবে তারা দিনে পাকবাহিনীকে সহযোগীতা করেন, আর রাতে তাদেরই বিরূদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এ প্রসঙ্গে শামসুল হুদা চৌধুরী ‘একাত্তুরের রণাঙ্গন’ গ্রন্থে সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন এভাবে, “কারণ এরাও (রাজাকাররা) সাহায্য করত। রাতে এসে আমাদের খবর দিয়ে দিত কিংবা আমরা গেলে তারা ইশারা দিয়ে আমাদের বলে দিত পাকস্তানী সৈন্য আছে কিনা, কিংবা তাদের অবস্থান কোথায় কোথায় ইত্যাদি।” (পৃষ্ঠা-১৮৭)। যুদ্ধকালে দেশে অবস্থান করে তারা অসহায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের প্রাণরক্ষাসহ মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোন তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। তারা বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শে উজ্জীবিত এক একজন বীর সেনা ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তারা যুদ্ধকালে ভারতপ্রবাসী তথা প্রশিক্ষণের নামে সেখানে অবস্থানকারীদের তুলনায় মুক্তিযুদ্ধে অনেক বেশি ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার পর তারা ভারতে অবস্থানকারীদের বিশেষ ক্যু’য়ের ফলে ‘পাকিস্তানী রাজাকার’ সাব্যস্ত হন। বঙ্গবন্ধুর ন্যায় তারা মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হন।
বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা-তালিকা আরো বিকৃত হয়েছে। প্রায় দুই লাখ ব্যক্তি ও একচল্লিশ নারী তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ তালিকাভুক্ত এবং তাদের পরিবার-পরিজন মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধার নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদে অবৈধ প্রাধান্য নিয়েছে। যেন শুধু তারাই বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। অন্য সবাই রাজাকার। খোদ বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানিও মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত নয়। এভাবে ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনও মুক্তিযোদ্ধা নয়। যে হাজার হাজার ভারতীয় সেনাসদস্য সশস্ত্র সংগ্রাম ও প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পাক হানাদারমুক্ত করেছেন, তারাও তালিকাভুক্ত নয়। এবং লাখ লাখ বন্দী ও শরণার্থীও মুক্তিযোদ্ধা তালিকা বহির্ভুত। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর মতো তালিকাবিহীন কেউই মুক্তিযোদ্ধা নয়।
ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের বিপরীতে প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা কোটানীতি সম্পুর্ণরূপে বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরূদ্ধ। পৃথিবীর কোথাও শহীদ ও যোদ্ধা সংখ্যায় এতো ব্যবধান নেই। যে কোনো যুদ্ধে শহীদের চেয়ে যোদ্ধা সংখ্যা বেশী হয়। যোদ্ধাদের মধ্যে শহীদ, বন্দী ও গাজী সবই থাকে। যোদ্ধাদের সকলেই শহীদ হয়না। তাদের একাংশ মাত্র শহীদ হয়। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও তাই হয়েছিল। সাড়ে সাত কোটি মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ত্রিশ লাখ শহীদ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু উক্ত যোদ্ধা ও শহীদের মাঝে পার্থক্য করেননি। তাই তার শাসনামলে দেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বৈষম্য ছিলনা।
যতদিন বাংলাদেশে প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধুসহ ত্রিশ লাখ শহীদ ও ৭১’এর প্রকৃত যোদ্ধাগণ রাজাকার বিবেচিত হবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মিথ্যা ও বিকৃত ইতিহাস রচিত হবে। শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক হবে। এসব মিথ্যাচারিতা ও বিতর্কের ফলে জাতি বিভাজন হবে। যা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি।
এজন্য উচিত, মুক্তিযুদ্ধের প্রচলিত ইতিহাস সংশোধন করা। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করা। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা অনুযায়ী ‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকেই মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করা। ত্রিশ লাখ শহীদসহ সকল বন্দী ও শরণার্থীদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়া। বর্তমানে প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করা। দেশের প্রতিটি নাগরিককে ‘৭১ এর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করা।
সবশেষে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ দেশবাসীর কাছে সশ্রদ্ধ জিজ্ঞাসা, বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত হবে কি ?