বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫
প্রথম পাতা » তথ্যপ্রযুক্তি | শিরোনাম | সর্বশেষ » ‘পুলিশের পরামর্শেই সাংবাদিকদের ভোট কেন্দ্রে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেছে ইসি ’
‘পুলিশের পরামর্শেই সাংবাদিকদের ভোট কেন্দ্রে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেছে ইসি ’
লালমোহন বিডিনিউজ,সোহেল ঢাকা: পৌরসভা নির্বাচনে সাংবাদিকদের ভোটের খবর সংগ্রহের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পুলিশের পরামর্শেই ইসি নির্বাচনের সময় সাংবাদিকদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের এই উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। এতে ভোটকক্ষে প্রবেশের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। এছাড়া সাংবাদিকরা ভোটকেন্দ্রে কী করতে পারবেন, কী করতে পারবেন না তাও উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে। ইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ইসি সচিবালয় সূত্রে জানা যায়, পুলিশের পরামর্শেই নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সময় সাংবাদিকদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনাররা কয়েকটি দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে এসে মত দিয়েছেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করেন না সাংবাদিকরা। কিন্তু এ দেশে ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশের কারণে নির্বাচনী কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। তাই তাঁদের বিচরণ নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত।
এদিকে ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইসি থেকে এ ধরনের নির্দেশনা দেয়ায় সাংবাদিকরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন না। বড় ধরনের অনিয়ম হলেও প্রিসাইডিং অফিসার অনুমতি না দিলে কোনো সাংবাদিক ভোটকক্ষে প্রবেশ করতে পারবে না। এ ধরনের নির্দেশনা আগে কোনো নির্বাচনে দেয়া হয়নি। সর্বশেষ মাগুরার একটি উপনির্বাচন থেকে এ কড়াকড়ি আরোপ করে যাচ্ছে কমিশন। তারা আরও বলেন, আগের কমিশন সাংবাদিকদের ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহিত করত এবং সাংবাদিকদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে নির্বাচনে অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত। বর্তমান কমিশন গত দুই নির্বাচন থেকে সাংবাদিকদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে আসছে।
যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ মঙ্গলবার বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের দেয়া বৈধ কার্ডধারীরা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন। তবে সেখানে বেশিক্ষণ অবস্থান করতে পারবেন না, অন্য সাংবাদিকদের কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ দেবেন। গোপন কক্ষের দিকে ক্যামেরা তাক করা যাবে না।
জানা গেছে, ইসির জনসংযোগ শাখার পরিচালক এসএম আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত নির্দেশনা রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এতে সাংবাদিকদের পাঁচটি নির্দেশনা মেনে চলার বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-প্রিসাইডিং কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া ভোটকক্ষে প্রবেশ করা যাবে না, কোনো প্রকার নির্বাচনী উপকরণ স্পর্শ বা অপসারণ করা যাবে না, সাংবাদিকরা ভোটে প্রার্থী বা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে যে কোনো ধরনের কর্মকা- থেকে বিরত থাকবেন, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তার জন্য সংবিধান, নির্বাচনী আইন ও বিধিবিধান মেনে চলবেন।
সূত্র মতে, সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনাররা দেশের বাইরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে এসে মতামত দিয়েছেন- যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকরা প্রবেশই করেন না। কিন্তু এদেশে ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশের কারণে নির্বাচনী কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। তাই তাদের বিচরণ নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত। এছাড়া ১৯ ডিসেম্বর আইনশৃংখলা সংক্রান্ত বৈঠকে কয়েকটি সংস্থার কর্মকর্তারা ভোটের দিন গণমাধ্যমের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতিমালা বা পরিপত্র জারির প্রস্তাব দেন। এর একদিন পরই ইসি থেকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করে চিঠি জারি করল কমিশন।
তবে নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, গণমাধ্যমের ওপর বিধি-নিষেধের ঘটনা দুঃখজনক। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কমিশন থেকে এ ধরনের নির্দেশনা দেয়া হলে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য বড় ধরনের হুমকি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচন ব্যবস্থাকে মেরুদ-হীন রকিব কমিশন অনেক আগেই ধ্বংস করেছে। এবার সাংবাদিকদের ওপর ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করে বাকিটুকুও শেষ হয়ে যাবে। এর ফলে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে সাংবাদিকদের আর স্বাধীনতা থাকল না। প্রিসাইডিং অফিসার অনুমতি না দিলে ভোটকেন্দ্রেই প্রবেশ করতে পারবেন না সাংবাদিকরা, এটা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। তিনি বলেন, এ ধরনের নির্দেশনা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাম্প্রতিক বক্তব্যের পরিপন্থী। তিনি বলেছিলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের সহায়ক শক্তি।
ইসির এসব নির্দেশনা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলেই মনে করছেন খোদ সংস্থাটির কর্মকর্তারাই। তাদের মতে, প্রথম নির্দেশনার জন্য ভোটকক্ষের ভেতরের কোনো বিশৃংখলার খবর পরিবেশনে অসুবিধা হবে। এক্ষেত্রে অনুমতি পেতে বিলম্ব হলে প্রকৃত ঘটনা জানাতে পারবে না গণমাধ্যম। এ নির্দেশনার ফলে ব্যালটপেপার বা বাক্স বা নির্বাচনী উপকরণ দুর্বৃত্তরা নষ্ট করলেও সে সংবাদের গভীরতা বা প্রমাণযোগ্যতা কমে যাবে।
এদিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আগে থেকেই রয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী নির্বাচন পর্যবেক্ষকদেরও অনুমতি নিয়ে ভোটকেন্দ্র ও কক্ষে যেতে হয়। পাঁচজনের বেশি পর্যবেক্ষক একসঙ্গে যেতে পারেন না। একই কেন্দ্রে সারাক্ষণ থাকারও সুযোগ নেই। আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি চেয়ে ইতিমধ্যে নিবন্ধিত পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো আবেদন করেছে।
অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে সাংবাদিকরা কখনো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন এমন অভিযোগ নেই। তার পরও ইসি এবারের পৌর নির্বাচনে সাংবাদিকরা যাতে ‘নির্বাচনের কাজে বাধা হতে না পারেন’ তার জন্য বিশেষ নির্দেশনা জারি করেছে। বলা হয়েছে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে যাওয়া সাংবাদিকদের প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমতি নিয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে হবে। এর ফলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা ভোটকেন্দ্রে বড় ধরনের অনিয়ম হলেও প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমতি ছাড়া কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন না সাংবাদিকরা। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন থেকে নেওয়া পরিচয়পত্র ও অনুমতিতেও কোনো কাজ হবে না।
ইসি সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই বলছেন, এ ধরনের নির্দেশনা মাঠপর্যায়ে পাঠানোর ফলে সাংবাদিকরা তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন না। প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমতি নিয়ে ভোটকেন্দ্রের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে গেলে সারা দিনে একজন সাংবাদিকও সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন কি না সন্দেহ রয়েছে। কারণ প্রিসাইডিং অফিসাররা সাংবাদিকদের অনুমতি দেওয়ার জন্য সেখানে বসে থাকেন না। তাঁদের অনেক কাজ রয়েছে। এ ধরনের নির্দেশনা আগে কখনো কমিশন থেকে দেওয়া হয়নি।
ওই কর্মকর্তাদের ধারণা, এ নির্দেশনার ফলে ভোটকক্ষের ভেতরের কোনো বিশৃ্খংলার খবর পরিবেশনে অসুবিধা হবে। এ ক্ষেত্রে অনুমতি পেতে দেরি হলে প্রকৃত ঘটনা জানাতে পারবে না গণমাধ্যম। ব্যালট পেপার বা নির্বাচনী উপকরণ দুর্বৃত্তরা নষ্ট করলেও সে সংবাদের গভীরতা বা প্রমাণযোগ্যতা কমে যাবে। এ ছাড়া এ নির্দেশনার মাধ্যমে সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিত তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কয়েক দিন আগে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘একটি ভোটকেন্দ্রে পাঁচজনের অধিক সাংবাদিক প্রবেশ করতে পারবেন না এবং একই কেন্দ্রে দীর্ঘক্ষণ অবস্থানও করা যাবে না।’ সে সময় ইসির পক্ষে বলা হয়েছিল, এ ধরনের বক্তব্য শুধু নির্বাচন কমিশনই দিতে পারে, অন্য কেউ নয়। কিন্তু তার পরও ওই নির্বাচনে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেওয়া এবং তাঁদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
তবে এ বিষয়ে ইসি সচিবালয়ের জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান বলেন, ভোটকেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসারই সব ক্ষমতার অধিকারী। প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমতি ছাড়া ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের সুযোগ কারো নেই।
আগের নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশন থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত সাংবাদিকদের ভোটকেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হয়নি। এবার তা হবে কেন জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এবারেও কোনো সমস্যা হবে না বলেই আশা করছি।’
জানা যায়, এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে আবেদন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় রিটার্নিং অফিসাররা ২৭ ডিসেম্বরের পরে সাংবাদিকদের পরিচয়পত্র সরবরাহ করবেন।